৭.১ শাসকরা এবং বিচারকরা যেভাবে ত্বাগুতে পরিণত হয়

 প্রথমেই ত্বাগুতের সংক্ষিপ্ত পরিচয় জেনে নেই। ত্বাগুত হচ্ছে বাতিল বা মিথ্যা ইলাহ। অর্থাৎ আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদের ইবাদত, অনুসরণ কিংবা আনুগত্য করা হয়। ত্বাগুত বিভিন্ন রকম হতে পারে। কোন জড় বস্তু যেমন মূর্তি, কোন বাতিল মতাদর্শ যেমন গণতন্ত্র এবং মানুষও ত্বাগুত হতে পারে। কোন মানুষ ত্বাগুত হওয়ার অর্থ হল, যখন কেউ নিজেই নিজেকে আল্লাহর আসনে বসায় এবং আল্লাহর পরিবর্তে তার নিজের দিকে মানুষকে আহবান করে তার ইবাদত তথা তার অনুসরণ ও আনুগত্য করার জন্য। কারণ অনুসরণ এবং আনুগত্য ইবাদতেরই অন্তর্ভুক্ত। এভাবে সে নিজেই ইলাহ সেজে বসে যায়, যদিও সে নিজেকে সরাসরি ইলাহ দাবি নাও করে। আর মানুষ তার আহবানে সাড়া দিয়ে তার অনুসরণ ও আনুগত্য করার মাধ্যমে আল্লাহর পরিবর্তে তারই ইবাদতে লিপ্ত হয়। এভাবে মানুষ ইসলাম থেকে বের হয়ে মুশরিকে পরিণত হয়।

সুতরাং ত্বাগুত হচ্ছে সবচেয়ে বড় ও জঘন্য কাফের এবং ইসলাম ও মুসলিমদের শত্রু। আর সাধারণ কাফেররা ত্বাগুতের ইবাদত, অনুসরণ আবং আনুগত্য করে। এবার আসি শাসক এবং বিচারকদের বিষয়ে। ইসলামে শাসক ও বিচারকরা হল আল্লাহর প্রতিনিধি। অর্থাৎ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যদি নিজেই সরাসরি এই দুনিয়াতে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন তাহলে তিনি যেভাবে তা করতেন, ইসলামে শাসকরা সেভাবেই শাসনকার্য পরিচালনার চেষ্টা করেন (অর্থাৎ আল্লাহর দেওয়া আইন তথা নিয়ম-কানুন অনুযায়ী সেই একইভাবে ফয়সালা করার চেষ্টা করা)। আর সেটা করার মাধ্যম আল্লাহ তাঁর রাসুলের মাধ্যমে যে শরীয়াহ আমাদেরকে দিয়েছেন তা অনুযায়ী শাসন পরিচালনা করা। অর্থাৎ ইসলামে শাসকরা নিজে থেকে কিছু করে না, বরং ইসলামী শরীয়াহর নির্দেশনা অনুযায়ী সবকিছু করে থাকে। এভাবে তারা দুনিয়াতে আল্লাহর প্রতিনিধি হয়ে মূলত আল্লাহর শাসনই বাস্তবায়ন করে থাকে।

একইভাবে বিচারকদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অর্থাৎ আল্লাহ নিজে সরাসরি বিচারকার্য সম্পাদন করলে যেভাবে করতেন, ইসলামে বিচারকরাও তাদের সাধ্যানুযায়ী তদ্রুপ করার চেষ্টা করে থাকেন। আর তা করার উপায় হল আল্লাহর নাযিলকৃত আইন বিধান অনুযায়ী বিচার ফয়সালা করা। এক্ষেত্রেও বিচারকরা নিজের মনমতো বানানো আইন দিয়ে কিংবা অন্য কারো বানানো আইন দিয়ে বিচার করে না, বরং আল্লাহর দেয়া আইন দিয়েই বিচার ফয়সালা করে থাকে। এভাবে তারা মূলত দুনিয়াতে আল্লাহর বিচারই বাস্তবায়ন করে থাকে। এ দুটো বিষয়ই আল্লাহর জন্য খাস। অর্থাৎ শাসন এবং বিচার একমাত্র আল্লাহর অধিকার। এতে আল্লাহর কোন শরীক নেই। এটা আল্লাহর তাওহীদ তথা একত্ববাদেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

সুতরাং যখন কোন শাসক আল্লাহর শরীয়াহকে বাতিল করে নিজেই শরীয়াহ রচনা করে এবং সে অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করে, তখন সে মূলত নিজেকে আল্লাহর আসনে বসায়। এভাবে সে মুখে দাবী না করলেও তার কাজের মাধ্যমে সে নিজেকে আল্লাহ দাবী করে। আর এভাবেই সে ত্বাগুতে পরিণত হয়। সুতরাং এক্ষেত্রে যারা তার অনুসরণ কিংবা আনুগত্য করবে তারা আল্লাহর পরিবর্তে তারই ইবাদতে লিপ্ত হয়ে মুশরিকে পরিণত হবে।

একইভাবে বিচারক যখন আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে নিজের মনমতো অন্য কোন আইন দিয়ে বিচার ফয়সালা করে, তখন সেও নিজেকে আল্লাহর আসনে বসায়। এভাবে সেও ত্বাগুতে পরিণত হয়। আর এসব বিচারকদের নিকট বিচার চাওয়ার মাধ্যমে, তাদের আইন, বিচারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মাধ্যমে বা তাদের বিচার ফয়সালার আনুগত্য করার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ আল্লাহর পরিবর্তে তাদের ইবাদতে লিপ্ত হয়ে মুশরিকে পরিণত হয়।

সুতরাং এই আলোচনার মাধ্যমে আমাদের বুঝে আসা উচিত যে আমাদের দেশের শাসকরা এবং বিচারকরা নিঃসন্দেহে ত্বাগুত। কারণ তারা আল্লাহর শরীয়াহ অনুযায়ী শাসনকার্য ও বিচারকার্য পরিচালনা করে না। বরং তারা তাদের নিজেদের তৈরি করা শরীয়াহ অনুযায়ী এসব করে চলেছে। তাই এরা ত্বাগুত।

আর ত্বাগুত বর্জন করা হল ঈমানের পূর্বশর্ত। নামাজের জন্য অযু শর্ত। অযু ছাড়া যেমন নামাজ হয় না, তেমনি এসব ত্বাগুতকে বর্জন করা ছাড়াও ঈমান আনা হবে না। এর দলীল হল নিম্নের আয়াতঃ

لَاۤ اِكۡرَاهَ فِی الدِّیۡنِ ۟ۙ قَدۡ تَّبَیَّنَ الرُّشۡدُ مِنَ الۡغَیِّ ۚ فَمَنۡ یَّكۡفُرۡ بِالطَّاغُوۡتِ وَیُؤۡمِنۡۢ بِاللّٰهِ فَقَدِ اسۡتَمۡسَكَ بِالۡعُرۡوَةِ الۡوُثۡقٰی لَا انۡفِصَامَ لَهَا ؕ وَاللّٰهُ سَمِیۡعٌ عَلِیۡمٌ

দ্বীনের মধ্যে জবরদস্তি নেই, নিশ্চয় হিদায়াত গোমরাহী হতে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। কাজেই যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার/বর্জন করল এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনল, নিশ্চয়ই সে দৃঢ়তর রজ্জু ধারণ করল যা ছিন্ন হওয়ার নয়। আল্লাহ সর্বশ্রোতা এবং সর্বজ্ঞাতা। [সূরা আল-বাকারাহ ২:২৫৬]

সুতরাং এই আয়াতে ত্বাগুতকে বর্জন করা আল্লাহর উপর ঈমান আনার জন্য শর্ত সাব্যস্ত করা হয়েছে।

যখন এরকম শাসক ও বিচারক থাকবে তখন করনীয়

দেখা যায় অনেক মুসলিমরা তারা এরকম তাগুত শাসকের হয়ে বিভিন্ন কাজ করছে। তারা যা বলছে তা মানছে, সেগুলো ইসলাম বিরোধী হোক আর নাই হোক। কারণ তারা রিজিকের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। তারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সাথে তাহাজ্জুদ পড়ছে, কান্না-কাটি করে ক্ষমা চাচ্ছে কিন্তু ঈমানের জোর এরকম যে ইসলাম বিরোধী কোন কাজ তাদের দ্বারা করালে তাতে তাঁরা না করতে পারছে না। তারা বলে, আমাদের কি করার, উপর থেকে নির্দেশ। নিরপরাধ মানুষকে জুলুম-নির্যাতন করে পিটিয়ে হাড় ভেঙ্গে দিচ্ছে, আর বলছে আমি তো চাকরি করি। আমার তো কিছু করার নেই, যা আদেশ দেয় তাই করতে হয়। তাদের কথা শুনে মনে হয় যদি তাদের আদেশ দেয় যে আপনার মা ও বোনকে রাতের জন্য পাঠান, উপর থেকে নির্দেশ তাহলে তারা তাও করতে রাজি হবে। আদৌ কি তাই করবে? করবে না, বিদ্রোহ করবে। কিন্তু তাদের হয়ে অন্যদের উপর একই জুলুম করতে তাদের এই বোধ হয় না। যদি একটি উদাহরণ দেই যা অহরহই ঘটে থাকে- একজনকে গুম করে হত্যা করার আদেশ এসেছে উপর থেকে যে চেয়েছিল দেশ বা রাষ্ট্র ইসলামী আইনে চলুক। এখন তাকে ধরতে গেল একজন সাধারণ রেঙ্কের বাহিনীর লোক। সে ধরে নিয়ে আসলো এবং উপরের স্যারদের হাতে তুলে দিল। উপরের স্যাররা তাকে ক্রসফায়ার দিয়ে হত্যা করলো। তখন সেই সাধারণ রেঙ্কের বাহিনীর লোক যে একটু আল্লাহ ভীরু তাদের থেকে, সে এই ভেবে খুশি যে যাক একজন নিরপরাধকে হত্যা তো আমার করতে হয়নি, অন্যরা হত্যা করেছে, তারাই এর দায় নিবে আল্লাহর কাছে। আমি তো শুধু ধরে এনেছি, তাও অনেক যত্ন করে এনেছি, মাঝে ভালো খাবারও খাইয়েছি, চাকরির খাতিরে এটা করাই লাগল। এরপর আল্লাহর কাছে দোয়া করে, হে আল্লাহ! আমার দ্বারা কোন নিরপরাধকে হত্যা করাইও না। উপরের নির্দেশে যা করি তা তো চাকরির জন্য করতেই হচ্ছে, কোন উপায় নেই।

কিন্তু সেই লোক এটা বুঝলো না যে সেও সেই হত্যায় শামিল হিসেবে আখিরাতে মামলা খাবে। এমনকি কেউ ইঙ্গিত দিয়েও যদি সাহায্য করে। এমনকি যদি পুরো বিশ্বের সকল মানুষ ও জীন জাতি একজন মুমিনকে হত্যায় কোন ছোট মাধ্যম দিয়েও জড়িত থাকে বা সেই হত্যার উপর সন্তুষ্ট থাকে, তাহলে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক তাদের সকলকে একসাথে জাহান্নামের আগুনে দিবেন, আর তা করা কোন বড় ব্যাপার নয়। আল্লাহর কাছে একজন মুমিনের মর্যাদা পুরো বিশ্ব থেকেও বেশি। তাহলে আপনার নামে কয়টা হত্যা মামলা হয়েছে হিসেব করে ফেলুন।

একা একজন শাসক কি এত কিছু করার ক্ষমতা রাখে নাকি আপনার সাহায্য নিয়ে করছে? সে কি নিরপরাধ একজনকে ধরে আনার যোগ্যতা রাখে নাকি আপনি ধরে নিয়ে তুলে দিয়ে তাকে এই কাজে সাহায্য করে দিলেন? সেই একজন শাসক কি সারাদিন গুম ঘর পাহারা দিতে পারে নাকি আপনি করে দিচ্ছেন? সেই একজন শাসক কি জেলখানা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে? কারারক্ষীর মতো গার্ড দিতে পারে নাকি আপনি এই কাজ তার হয়ে করে দিচ্ছেন? আর বলছেন আমি তো কিছু করছি না, শুধু এতটুকু করছি। আজ যদি প্রশাসনের সব স্তর থেকে কাজ দিয়ে ইস্তফা দিয়ে দেয় বা বিদ্রোহ করে তাহলে একা এক প্রধানমন্ত্রী কি কিছু করার ক্ষমতা রাখে নাকি সে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী? সে কি একা এতকিছু করছে নাকি আপনারাই করছেন? সে কি একাই জালিম না আপনারাও? একটু চিন্তা করে দেখা প্রয়োজন। প্রশাসনের অনেক ঈমানদার ভাইদের ব্যাপারেও জানা, কিন্তু তারা এমন এক অবস্থায় আছে যা থেকে তারা মুক্ত হওয়ার পথই পাচ্ছে না। কারণ সেখান থেকে বের হলে, উপরের লোকেরাই আবার তার বিরুদ্ধে লাগবে। এরকমও আছে যে প্রশাসনের একজন ঈমানদার ভাইকে সেই প্রশাসনের লোকেরাই জুলুম-নির্যাতন করছে দিন-রাত। দোষ ছিল শুধু ন্যায্য কথাটি বলে ফেলা। তাই যারা জালিম বাহিনীতে আছেন তাদের উচিত তা থেকে বেরিয়ে আসা। আর যদি একান্তই না হয় তাহলে উচিত যথাসাধ্য ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করা এবং সর্বদিক দিয়ে মাজলুমদের উপকার করার চেষ্টা করা। এরকম অসংখ্য লোক প্রশাসনে-বাহিনীতে রয়েছে যারা মাজলুম ও ইসলাম প্রিয় মানুষদের সাহায্য-সহযোগিতা করে যাচ্ছে যদিও তাতে ঝুঁকি রয়েছে। তাই নিয়তকে তাদের মতো এখন থেকেই বদলে ফেলা।

এছাড়াও এরকম শাসক থাকলে কি করণীয় তা স্বাভাবিকভাবেই বুঝে আসার কথা। ইসলামী বিধান হচ্ছে চোরদের হাত কাটা। এই বিধানকে বাদ দেওয়া হয়েছে ও জেল-জরিমানার বিধান দিয়েছে কিন্তু তাতে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। এখন কালকে যদি শাসক বলে যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিধান সেটি এখন থেকে নতুন বিধান ৩ ওয়াক্ত হবে। আপনি হয়তো মনে মনে বলবেন এটা মেনে নিবো না, যাই হয়ে যাক, দরকার হলে চাকরি ছেড়ে দিবো, বিদ্রোহ করবো। কিন্তু এখানে তো কোন পার্থক্য নেই। ৫ ওয়াক্ত নামাজের বিধান এটাও আল্লাহ দিয়েছেন, একইভাবে চোরের শাস্তির বিধানও। তাহলে একটা মানছেন আর একটা মানছেন না। তাই যেসকল শাসক রয়েছে যারা আল্লাহর বিধানকে পরিবর্তন করে তাদেরকে হটিয়ে ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কারণ যারা আল্লাহর আইন বাদ দিয়েছে ও ইচ্ছামতো আইন করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে যা রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার কোন সেক্টরকেই বাদ দেয় না তাহলে তাদের সাথে বিদ্রোহ করে, জিহাদ করে ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠা করা সবার জন্য ওয়াজিব। এভাবেই সব বিশৃঙ্খলা দূর হয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে। এভাবেই মুসলিমদের জাগরণ হয়ে ইসলামী আইন তথা ইসলামী খিলাফত-সালতানাত যুগে যুগে প্রতিষ্ঠিত হয়ে এসেছে। এমনকি একশত বছর আগেও ইসলামী হুকুমাতের অস্তিত্ব ছিল আর তা বেশি দিন নয়। আবারো তা প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু এই প্রচেষ্টা করে যে অনেকেই হারিয়ে গেছেন, হত্যা-গুম হয়েছেন, সফলতা পায়নি। যেমনটি করেছিলেন হযরত হুসাইন (রা:) এবং তার পরবর্তীগণ। আর তারা বিজয়ী না হলেও জালিম শাসকদের হাতে হত্যা হয়ে সর্বোত্তম শহীদ হিসেবে কবুল হয়েছেন। তাই যারা দ্বীন কায়েমের চেষ্টায় রত আছেন তাদের এই কাজে ক্ষতির কোন বিষয়ই নেই। হয়তো শরীয়ত, নয়তো শাহাদাত। এটাই যুগ যুগ ধরে চলে আসা সত্য স্লোগান।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ