৩.১৫ বার জন আমীর বা ইমাম নিয়ে হাদিস ও শিয়া আকিদার সাথে মিল নিয়ে ভ্রান্তি নিরসন

 বর্তমানে দেখা যায় যে, আল্লাহ প্রদত্ত নেতা, ইমামগণ আসবে বা ইমাম মাহদী ছাড়া আরো নেতাদের আবির্ভাব হবে হাদিস থেকে পাওয়া যায়। তার বিষয়ে কথা বললেই বলা হয় এগুলো শিয়াদের আকিদা-বিশ্বাস। যারা এটি বলে থাকে তাদের এ বিষয়ে অর্ধেক জ্ঞান রয়েছে। আকিদার বিষয়ে বলার আগে আসুন ১২ জন ইমাম বা আমীরগণ এর আগমন এবং তৎসংশ্লিষ্ট হাদিসগুলো দেখি যা আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ এর প্রসিদ্ধ হাদিসগ্রন্থ সমুহে বর্ণিত হয়েছে।

আবূ কুরায়ব (রহঃ) ..... জাবির ইবন সামুরা (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ বলেছেনঃ আমার পর বার জন আমীর হবেন। জাবির (রা:) বলেন, এরপর রসূলুল্লাহ কিছু বললেন। কিন্তু আমি তা বুঝতে পারিনি, তাই আমার কাছে যে ব্যক্তি ছিলেন তাঁকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, নবী বলেছেন, তারা প্রত্যেকেই কুরায়শ গোত্রভুক্ত হবেন।
-       (সহীহ, সুনান আত তিরমিজী (আল মাদানী প্রকাঃ) ২২২৩ [ইঃ ফাঃ ২২২৬]; সহিহাহ ১০৭৫; বুখারী)

হযরত জাবের বিন সামুরা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল কে আমি বলতে শুনেছি যে, এই দ্বীন (ধর্ম) প্রতিষ্ঠিত থাকবে ততদিন পর্যন্ত, যতদিন না তোমাদের মাঝে ১২ জন খলীফাহ না আসে। তারা সবাই তাদের প্রত্যেক উম্মতকে নিজের নিকট একত্রিত করবে। সাহাবী বলেন, তারপর রসূল একটি কথা বললেন, তা আমি বুঝতে পারিনাই। আমি আমার পিতাকে প্রশ্ন করলাম রসূল কি বলেছেন? পিতা বললেন, তিনি বলেছেন, খলিফাহ সকলেই কুরাইশদের মধ্য থেকেই হবে।
-       (সহীহ, সহীহ মুসলিম ইঃ ফাঃ ৪৫৫৪, ৪৫৫৭, ৪৫৫৮, ৪৫৫৯; আবু দাউদ ৪৯৭৯ [ইঃ ফাঃ ৪২৩০])

বুনদার (রহঃ) ...... যিয়াদ ইবন কুসায়ব আদওয়ী (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলে, আমি ইবন আমীরের মিম্বরের নীচে আবূ বকরা রাঃ-এর সঙ্গে বসেছিলাম। তিনি খুতবা দিচ্ছিলেন। তার পরনে ছিল হালকা পাতলা ধরণের পোশাক। তখন আবূ বিলাল (রহঃ) আমাকে বললেনঃ আমাদের আমীরের দিকে চেয়ে দেখ, ফাসিকদের অনুরূপ পোষাক পরেছেন। আবূ বকর (রা:) বললেনঃ চুপ কর, আমি রসূলুল্লাহ -কে বলতে শুনেছিঃ যে ব্যক্তি যমীনে আল্লাহর নিযুক্ত সুলতানকে অপমান করবে আল্লাহ তাআলা তাকে লাঞ্চিত করবেন। (আবু ঈসা বলেন) এ হাদীসটি হাসান-সহীহ।
-       (হাসান, সুনান আত তিরমিজী (আল মাদানী প্রকাঃ) ২২২৪ [ইঃ ফাঃ ২২২৭]; সহিহাহ ২২৯৬)

কুতায়বা ইবনু সাঈদ ও আবূ বাকর ইবনু আবূ শায়বা (রহঃ) ... আমর ইবনু সাদ ইবনু আবূ ওয়াক্কাস (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি জাবির ইবনু সামুরা (রা:) এর নিকট আমার গোলাম নাফি' মারফত পত্র পাঠালাম যে, আপনি আমাকে এমন কিছু সম্পর্কে অবহিত করুন যা আপনি রসূলুল্লাহ এর নিকট শুনেছেন। রাবী বলেন, তিনি আমাকে লিখলেনঃ জুমার দিন সন্ধ্যায় যে দিন (মা'ইজ) আসলামীকে রজম করা হয়, সেদিন আমি রসূলুল্লাহ কে বলতে শুনেছি, এ দ্বীন অব্যাহতভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকবে যতক্ষন কিয়ামত কায়েম হয় অথবা তোমরা বারজন খলীফা কর্তৃক শাসিত হও, এদের সকলেই হবে কুরায়শ থেকে।

আমি তাঁকে আরও বলতে শুনেছি, মুসলমানদের একটি ছোট দল জয় করবে শ্বেতভবন যা কিসরা (কিংবা কিসরা বংশের) মহল। আমি আরও বলতে শুনেছি, কিয়ামতের প্রাক্কালে অনেক মিথ্যাবাদীর আবির্ভাব হবে, তোমরা তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকবে। আমি তাঁকে আরও বলতে শুনেছি তোমাদের কাউকে যখন আল্লাহ কল্যাণ (সম্পদ) দান করেন তখন সে নিজের এবং তার পরিবারস্থ লোকজনকে দিয়ে (ব্যয়) শুরু করবে। আমি তাঁকে আরও বলতে শুনেছি, হাওযে (কাওসারে) আমি তোমাদের অগ্রগামী হবো।
-       (সহীহ মুসলিম ইসঃ ফাঃ ৪৫৬০)

হুসায়ন ইবন মুহাম্মদ বাসরী (রহঃ) ..... আবদুল্লাহ ইবন আবূ হুসায়ন (রহঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাবীআ গোত্রের কিছু লোক আমর ইবন আস (রা:) এর নিকট উপস্থিত ছিল। বাকর ইবন ওয়াইলের এক ব্যক্তি তখন বললঃ কুরায়শদের অবশ্যই অন্যায় কর্ম থেকে বিরত হওয়া উচিত নইলে আল্লাহ তাআলা খিলাফতের দায়িত্ব (তাদের থেকে ছিনিয়ে নিয়ে) সাধারণ আরব অনারদের দিয়ে দিবেন। আমর ইবন আস (রা:) বললেনঃ তুমি ভুল বলছ, আমি রসূলুল্লাহ -কে বলতে শুনেছিঃ ভাল-মন্দ সব অবস্থায় কিয়ামত পর্যন্ত কুরায়শরা লোকদের নেতৃত্ব দিবে।
-       (সহীহ, সুনান আত তিরমিজী (আল মাদানী প্রকাঃ) ২২২৭ [ইঃ ফাঃ ২২৩০]; সহিহাহ ১১৫৫)

হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ বলেছেনঃ জাহান্নামের দিকে আহবানকারী লোকদের আবির্ভাব হবে। যারা তাদের আহ্বানে সাড়া দিবে তাদেরকে তারা জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমাদের নিকট তাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করুন। তিনি বলেনঃ তারা আমাদের মধ্য থেকে হবে এবং আমাদের ভাষায় কথা বলবে। আমি বললাম, তারা যদি আমাকে পায় তবে আপনি আমাকে কি নির্দেশ দেন? তিনি বলেনঃ তুমি অপরিহার্যরূপে মুসলিমদের সংঘভুক্ত থাকবে এবং তাদের ইমামের (আমীর বা খলীফার) আনুগত্য করবে। যদি মুসলিমগণ ঐক্যবদ্ধ না থাকে এবং তাদের ইমামও না থাকে তাহলে তুমি তাদের সকল বিচ্ছিন্ন দল থেকে দূরে থাকো এবং কোন গাছের কান্ড আঁকড়ে ধরো এবং সেই অবস্থায় যেন তোমার মৃত্যু হয়।
-       (সহীহ, সুনান ইবনু মাজাহ তাঃ পাঃ ৩/৩৯৭৯; সহীহুল বুখারী ৩৬০৬; সহীহুল মুসলিম ১৮৪৭; আবূ দাউদ ৪২৪৪; মুসনাদে আহমাদ ২২৯৩৯; সহীহাহ ২৭৩৯)

হুযায়ফা (রা:) বলেনঃ লোকেরা রসূলুল্লাহ্‌ এর নিকট কল্যাণ ও মঙ্গলের বিষয়াদী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতো এবং আমি তাঁর নিকট অকল্যাণের বিষয়াদী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতাম। এ কথা শুনে লোকেরা তাঁর প্রতি বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকাতে থাকলে, তিনি বলেনঃ আমার কথা যারা খারাপ মনে করে, আমি তাদের দেখতে পাচ্ছি। এরপর তিনি বলেন, একদা আমি বলিঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ্‌! মহান আল্লাহ্‌ আমাদের যে কল্যাণ ও মঙ্গল দান করেছেন, এরপর কি আবার খারাপ অবস্থার সৃষ্টি হবে, যেমন আগে ছিল? তিনি বলেনঃ হ্যাঁ। আমি বলিঃ এর থেকে বাঁচার ব্যবস্থা কি? তিনি বলেনঃ তরবারি। আমি জিজ্ঞাসা করিঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ্‌! এরপর কি হবে? তিনি বলেনঃ এ সময় পৃথিবীতে যদি আল্লাহ্‌র কোন প্রতিনিধি (খলীফা) থাকে এবং সে জুলুম করে তোমার পিঠ ভেঙ্গে দেয়, তোমার ধন-সম্পদ লুট করে নেয়, তবুও তুমি তার আনুগত্য করবে। আর যদি এরূপ কেউ না থাকে, তবে তুমি জঙ্গলে চলে যাবে এবং গাছের লতা-পাতা খেতে খেতে মরে যাবে। (প্রয়োজনীয় অংশ)
-       (সহীহ, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত/ আলবানী একাঃ) ৪২৪৪ [ইঃ ফাঃ ৪১৯৬]; আহমাদ)

হযরত হুযায়ফা (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, লোকেরা রসূলুল্লাহ এর নিকট কল্যাণ সম্পর্কে প্রশ্ন করত। আর আমি ক্ষতিকর বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতাম এই ভয়ে যেন আমি তাতে লিপ্ত না হই। একদিন আমি রসূল এর নিকট বসা ছিলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে যেই কল্যাণ দান করেছেন সেই কল্যাণে পর কি পুনরায় অকল্যাণ দান করেছেন। সেই কল্যাণের পর কি পুনরায় অকল্যাণ আসবে? যা পূর্বেও ছিল। তিনি বললেন হ্যাঁ, আসবে। আমি পুনরায় জিজ্ঞাসা করলাম তারপর কি হবে? রসূল বললেন, ধোকার উপর সন্ধি চুক্তি হবে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, সন্ধিচুক্তির পর কি হবে? তিনি বললেন, কতিপয় আহ্বানকারী গোমরাহীর দিকে আহ্বান করবে। যদি তুমি তখন আল্লাহর কোন খলীফা (আল্লাহর মনোনীত আমীর বা ইমাম) এর সাক্ষাৎ পাও তাহলে অবশ্যই তার আনুগত্য করবে।
-       (যঈফ, আল ফিতান: নুয়াইম বিন হাম্মাদ ৩৪; নুযুলে ঈসা ৩৯; এ বিষয়ে সহীহ সনদের হাদিস রয়েছে)

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ এরশাদ করেছেন, মুসা (আঃ) এর উপদেষ্টাদের মত আমার পরেও কতক খলীফা আত্নপ্রকাশ করবে।
-       (যঈফ, আল ফিতান: নুয়াইম বিন হাম্মাদ ২২৪; ইতহাফুল খিয়ারাতুল মাহারা ৬০১৩)

হযরত জাবের ইবনে সামুরা (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ এরশাদ করেছেন, খেলাফতের জিম্মাদারী কুরাইশের বারোজন খলীফার দায়িত্বে থাকা পর্যন্ত সেটা খুবই সম্মানিত ও সুচারু রূপে পরিচালিত হবে।
-       (সহীহ, আল ফিতান: নুয়াইম বিন হাম্মাদ ২২৫; সহীহুল মুসলিম ৩৪০৪)

মুহাম্মাদ ইবনু বাশশার (রহঃ) ... আবূ হাযিম (রহঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি আবূ হুরায়রা (রা:) এর সাথে পাঁচ বছর অবস্থান করেছি। আমি তার কাছে শুনেছি, নাবী বলেছেনঃ বনি ইসরাঈলদের পরিচালনা (রাজত্ব) করতেন নাবীগণ। তাদের মধ্যকার একজন নাবী মৃত্যুবরণ করলে অপর একজন নাবী তাঁর স্থলালাভিষিক্ত হতেন। আমার পরে আর কোন নাবী নেই বরং খলীফাগণ হবেন এবং তারা সংখ্যায় প্রচুর হবেন। তখন সাহাবীগণ বললেনঃ তাহলে আপনি (এ ব্যাপারে) আমাদেরকে কি নির্দেশ দেন? তিনি বললেনঃ যার হাতে প্রথম বায়ঁআত (আনুগত্যের শপথ) করবে, তারই আনুগত্য করবে এবং তাদেরকে তাঁদের হক (অধিকার) প্রদান করবে, আর আল্লাহ্‌ তা'আলা তাদের কর্তৃত্তাধীনে প্রদত্ত ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।
-       (সহীহ, সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) | অধ্যায়ঃ ৩৪/ রাষ্ট্রক্ষমতা ও প্রশাসন (كتاب الإمارة) | হাদিস নাম্বার: ৪৬২১)

হযরত জাবির ইবনে সামুরা (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলে পাক () কে আমি বলতে শুনেছি। সত্য কে দৃঢ় রাখার জন্য বার জন আমীর আসবে অতঃপর হযরত নবী () আরও একটি কথা বলেছেন, যা আমি শুনতে পাইনি। (পরে) আমার পিতা বলেছেন, তাদের সকলেই কুরাইশ বংশের হবেন।
-       (সহীহ, আস সুনানু কিতাবুল ফিরদাউস ৭৬৩)

হযরত আবু তোফাইল (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর আমার হাত ধরে বললেন, হে আমের ইবনে ওয়সিলা! কাব ইবনে লুআই এর বংশধর থেকে মোট বারোজন খলীফা হওয়ার পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ে মারাত্নক বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে। এরপর কিয়ামত পর্যন্ত আর কোনো ইমামের উপর লোকজন ঐক্যমত পোষন করবে না।
-       (যঈফ, আল ফিতান: নুয়াইম বিন হাম্মাদ ২২৬)

হযরত তালহা ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আওফ (রহ:) বলেন, আমি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা:) কে বলতে শুনেছি, তখন আমরা সেখানে কয়েক জন কুরাইশ উপস্থিত ছিলাম, আমাদের প্রত্যেকে কাব ইবনে লুআই এর বংশধর থেকে ছিলাম। তিনি বলেন, হে বনু কাব! তোমাদের থেকে মোট বারোজন খলীফা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করবেন।
-       (যঈফ, আল ফিতান: নুয়াইম বিন হাম্মাদ ২২৭)

হযরত কাব (রহ:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এ উম্মতের জন্য এমন কতক খলীফা নিযুক্ত থাকবে, যারা দীর্ঘদিন পর্যন্ত খেলাফতের জিম্মাদারী পালন করবে। তারা লোকজনকে যাবতীয় রসদ পত্র সরবরাহ করবে এবং কর ও জিযিয়া গ্রহণ করবে। এই অবস্থা হযরত ঈসা (আঃ) এর আগমন পর্যন্ত চলবে। তিনি তাদের সবাইকে একত্রিত করবেন। অতঃপর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাত ছাড়া হয়ে যাবে (অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ে নিবেন)।
-       (যঈফ, আল ফিতান: নুয়াইম বিন হাম্মাদ ২৩৮)

হযরত হুযাইফা (রা:) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, লোকেরা রসূলুল্লাহ -কে কল্যাণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতো, আর আমি জিজ্ঞেস করতাম মন্দ সম্পর্কে -এই ভয়ে ভীত হয়ে যে পাছে তা আমাকে পেয়ে বসে কিনা। আমি জিজ্ঞেস করলাম: ইয়া রসূলাল্লাহ! আমরা জাহেলিয়াত ও মন্দের ভিতরে ছিলাম। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে (আপনার মাধ্যমে দ্বীন ইসলামের মতো) এই কল্যাণ এনে দিলেন। এই কল্যানের পর কি কোনো মন্দ কিছু আছে? তিনি বললেন: হ্যাঁ। আমি বললাম: সেই মন্দের পর কি কোনো কল্যানের কিছু আছে? তিনি বললেন: হ্যাঁ, আর তাতে থাকবে দুখান (ধোঁয়া)। আমি জিজ্ঞেস করলাম: ওই দুখান কি? তিনি বললেন: (সে জামানায়) এমন গোষ্ঠি (-র আবির্ভাব হবে) যারা (মানব সমাজে আমার আনীত) আদর্শ বহির্ভূত আদেশ জারি করবে এবং (আমার দেখানো) পথনির্দেশিকা বহির্ভূত (পথের দিকে মানুষজনকে) পথ দেখাবে (তাদেরকে পরিচালিত করবে)। তাদের মধ্যে মারুফ (ভালো) বিষয়ও (দেখতে) পাবে এবং মুনকার (খারাপ) বিষয়ও পাবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম: এই কল্যানের পর কি কোনো মন্দ রয়েছে? তিনি বললেন: (এদের পর এমন গোষ্ঠির আবির্ভাব হবে যারা মানব জাতিকে এমন মত ও পথের দিকে ডাক দিবে, যা হবে মূলতঃ) জাহান্নামের বিভিন্ন দরজা থেকে (দেয়া) ডাক। যে ব্যাক্তি তাদের ডাকে সেদিকে সারা দিবে, তারা তাকে ওর মধ্যে নিক্ষেপ করবে। আমি বললাম: ইয়া রসূলাল্লাহ! আমাদেরকে তাদের বৈশিষ্ট (কী হবে তা) বলে দিন। তিনি বললেন: (এই জাহান্নামী পথভ্রষ্ঠ) গোষ্ঠিটির চামড়া আমাদের মতোই হবে, তারা কথাও বলবে আমাদের (মুসলমানদের) ভাষা (ভঙ্গি)তে। আমি বললাম: ইয়া রসূলাল্লাহ ! আমি যদি তাদেরকে পাই, তাহলে আপনি আমাকে কি করতে বলেন? তিনি বললেন: মুসলমানদের জামাআত ও তাদের ইমামকে আঁকড়িয়ে ধরে থাকবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম: যদি (তখন) কোনো জামাআতও না থাকে, কোনো ইমামও না থাকে? তিনি বললেন: তাহলে ওই প্রতিটি ফেরকা থেকে নিজকে বিছিন্ন করে রাখবে- যদিও-বা তোমাকে গাছের শিকড় খেয়ে থাকতে হয় এমনকি এ অবস্থার উপরই তোমার মৃত্য চলে আসে।
-       (সহীহ, সহীহ মুসলিম ৩/১৪৭৪ হাঃ ১৮৪৭; সহীহ বুখারী তাঃ পাঃ ৩৬০৬; মুসনাদে আবু আউয়ানাহ ৪/৪১ হাঃ ৫৭৫৭, ৫৭৫৮]

হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা:) বলেন, রসূল একদিন এক মজলিসে ভাষণ দিতে গিয়ে বললেন, হে মানব সকল! তোমরা কি আল্লাহর জান্নাত লাভ করতে চাও না? সকলেই বলে উঠল, হে আল্লাহর রসূল আমি চাই, আমি চাই। তিনি বললেন, তোমরা কি আল্লাহর নিকট জবাবদিহি থেকে মুক্তি চাও না? উপস্থিত সকলে বলল, আমি চাই, আমি চাই। আল্লাহর রসূল বললেন, তাহলে আল্লাহর দ্বীনের হক আদায় করো।
-       (আস-সুনানু কিতাবুল ফিরদাউস ১১২৮)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) বলেন, রসূল বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর মনোনীত দ্বীনের হক আদায় করবে, আল্লাহ তা'আলার জান্নাত তাঁর জন্য আবশ্যক যদি সে এই অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রসূল ! দ্বীনের হক কি? তিনি বলেন, যে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করবে, আর আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তিদের সন্নিকটে (আনুগত্য করবে) থাকবে। এ কথা বলে আল্লাহর রসূল সূরা নিসার ৫৯ নম্বর আয়াত পাঠ করে শোনালেন। *
-       (আস-সুনানু কিতাবুল ফিরদাউস ১১২৫)

-       * সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াতটি হচ্ছে- হে বিশ্বাসীগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস কর, তাহলে তোমরা আল্লাহর অনুগত হও, রসূল ও তোমাদের নেতৃবর্গ (মনোনীত আমীর বা নেতা) দের অনুগত হও। আর যদি কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটে, তাহলে সে বিষয়কে আল্লাহ ও রসূলের (কুরআন ও সুন্নাহ) দিকে ফিরিয়ে দাও। এটিই হল উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর।

এসকল হাদিসগুলোতে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে যে, বারো জন খলীফা বা আমীর বা ইমাম এর আগমন সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। এরকম আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ এর গৃহীত অসংখ্য কিতাব থেকে অসংখ্য হাদিস রয়েছে। কিন্তু এরপরও বলছে এ সকল ইমাম বা আমীরের আবির্ভাব এগুলো শিয়াদের বিশ্বাস। আসলে শিয়াদের এ বিষয়ে আকিদা কি? সেটি কি জানা আছে?

আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ এর আকিদা অনুসারে কুরাইশ থেকে বারো জন খলীফা বা আমীর বা ইমাম এর আবির্ভাব ঘটবে এবং সর্বশেষ ইমাম মাহদী যার নাম হবে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ।

শিয়াদের আকিদা হচ্ছে শুধু মাত্র আহলে বাইত (অর্থাৎ হাসান (রা:) ও হুসাইন (রা:) এর বংশ) থেকেই বারো জন খলীফা বা আমীর বা ইমাম এর আবির্ভাব ঘটবে। এবং তারা অন্য কাউকে ইমাম মাহদী হিসেবে বিশ্বাস করে যে হচ্ছে একাদশ ইমাম হাসান আল-আসকারীর পুত্র এবং বর্তমানে অন্তর্হিত, হলেন প্রতীক্ষিত মাহদী। অর্থাৎ তাদের দুটি জায়গাতে সমস্যা দেখা যায়, তা হচ্ছে তারা সব ইমামকেই মনে করে যে তারা আহলে বাইত থেকে হবে অথচ হাদিসে রয়েছে তারা কুরাইশী হবে। আহলে বাইত থেকে আর কুরাইশ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। এটা বাড়াবাড়ি। আরেকটি বিষয় হচ্ছে তারা যাকে ইমাম মাহদী মনে করে তার ব্যাপারটিও আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা মনে করে একাদশ ইমাম হাসান আল-আসকারীর পুত্র এবং বর্তমানে অন্তর্হিত, হলেন প্রতীক্ষিত মাহদী। এই একাদশ ইমাম যাকে তারা বানিয়েছে যে ইমাম হাসান আল আসকারী এটাও শিয়াদের তৈরিকৃত। কারণ একাদশতম ইমাম বা আমীর অন্যকেউ। এবার আবার আসা যাক তারা যাকে ইমাম মাহদী মনে করে থাকে তার ব্যাপারে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায় এ ব্যাপারে তাদের আকীদা তথা বিশ্বাস হচ্ছে-

তিনি (অর্থাৎ ইমাম মাহদী) ২৫৫ হিজরীর ১৫ই শাবান তথা আব্বাসীয় খলিফা আল-মুহতাদীর খেলাফত সময় শেষ হওয়ার ১৫ বা ১৬ দিন পর জন্মলাভ করেন। তাঁর মাতা উম্মে ওয়ালাদ ছিলেন রোমীয়, যার নাম ছিল নারজিস এবং অপর এক বর্ণনার ভিত্তিতে মালিকাহ। তাকে রোমের সেজারের (সম্রাটের) দৌহিত্রী বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। আর এ মহিয়সীর সাথে ইমাম হাসান আসকারী (আ.) এর বিবাহের বিষয়ে, ইমাম (আ.) এর জন্ম এবং তাঁর হতে যে সকল মোজেযা পরিলক্ষিত হয়েছে সে সকল বিষয়ে অনেক রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে।

জন্মের পর হতে ইমাম (আ.) কে লোক চক্ষুর অন্তরালে রাখা হত। কিন্তু ইমাম পরিবারের কিছু কিছু সদস্য অথবা ইমামের বিশেষ কিছু সাহাবীগণ তাঁকে দর্শনে সক্ষম হয়েছেন এবং এ সময় ইমাম (আ.) তাঁর শীঘ্রই আগত অন্তর্ধান সম্পর্কে তাদেরকে অবগত করেছিলেন।

তার অবয়বের বর্ণনা দিতে গিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি চেহারা ও আচরণের দিক থেকে আল্লাহর রসূল এর সাদৃশ্য। তার চেহারা হচ্ছে উজ্জ্বল এবং তার ডান চিবুকে রয়েছে একটি কালো তিল, দাঁতগুলো পরস্পর হতে বিচ্ছিন্ন এবং তার চেহারায় একটি বিশেষ চিহ্ন রয়েছে।

তাহলে স্পষ্টই দেখা যায় যে কি কি বিষয় শিয়াদের সাথে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ এর বিপরীত রয়েছে। তারা ইমাম মাহদী সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করেছে এবং মনে করে থাকেন যে ১০০০ বছরের বেশি সময় ধরে সে জীবিত রয়েছে এবং গুপ্ত আছে। এটা আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ বিশ্বাস করে না এবং কোন দলিলও সেটা বলে না। কারণ দলিল বলে যে তিনি ৪০ বছর বয়সে আত্মপ্রকাশ করবেন। আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ যেমন বিশ্বাস করে তিনি হাসান (রা:) এর বংশ থেকে আসবেন শেষ জামানায় তার জন্ম হবে আর ৪০ বছর বয়সে আত্মপ্রকাশ করে ক্ষমতায় যাবেন কিন্তু শিয়ারা বিশ্বাস করে সে ইমাম হাসান আসকারী (আ.) এর পুত্রই ইমাম মাহদী এবং তার জন্ম হয়েছে ২৫৫ হিজরীতে অর্থাৎ প্রায় ১২০০ হিজরি বছর থেকে গুপ্ত আছেন বা জীবিত আছেন। এটি ইমামগণ ও ইমাম মাহদী সম্পর্কে বাড়াবাড়ি। এখন শিয়ারা এরকম বাড়াবাড়ি করে বলে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ কি ইমাম মাহদীর আগমনকে অস্বীকার করে? বারো জন আমীর বা ইমামগণের আগমনকে কি অস্বীকার করে বসে থাকবে? না। যেটা সঠিক ও মধ্যমপন্থা সেটাই আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ এর আকিদা ও মানহাজ। যেমন একটি উদাহরণ দেই এই বিষয়ে, শিয়ারা হযরত আলী (রা:) কে নিয়ে যেরকম বাড়াবাড়ি করে, তাকে ইমাম মানে ও রসূল থেকেও অনেক সময় শ্রেষ্ঠ মানে এজন্য কি আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ হযরত আলী (রা:) কে অস্বীকার করে? তার যথাযথ মর্যাদাকে কি অস্বীকার করে? প্রশ্নই উঠে না। তিনি একজন মর্যাদাবান সাহাবী ও রসূল এর আহলে বাইত সদস্য, খুলাফায়ে রশিদীন এর একজন। এটাই আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ এর আকিদা মানহাজ। আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ হচ্ছে সব বিষয়ে মধ্যম পন্থা ও সহীহ সুন্নাহ গ্রহণে অগ্রগামী। শিয়াদের মতো যেখানে এসব বিষয়ে বাড়াবাড়ি হচ্ছে আপনারা তাহলে কেন এসব বিষয় নিয়ে একদম ছাড়াছাড়ি করছেন বা অস্বীকার করছেন? যেখানে স্পষ্ট দলিল-প্রমাণ উপস্থিত রয়েছে যা আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ এর সকল যুগের সকল ফকীহ, মুহাদ্দিসগণ গ্রহণ করেছেন এবং তার উপর কোন সময় প্রশ্ন তুলে নি। তাই যারা এই বিষয়ে ছাড়াছাড়ি করবেন তারাও আর আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ এর মধ্যে থাকবেন না যেমন শিয়ারা বাড়াবাড়ি করে এ থেকে বের হয়ে গেছে।

তবে এর সাথে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য তা হচ্ছে, এরকম আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তি, খলীফা, আমীর বা ইমামগণের আগমনের ব্যাপারটি যখন দলিলযোগ্য ও সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় তখন এখানে একটি ফিতনার দরজা খুলে থাকে যা হচ্ছে বিভিন্ন ভণ্ডের আবির্ভাব। তার মধ্যে ইমাম মাহদীর ব্যাপারে যেহেতু সবচেয়ে বেশি দলিল-প্রমাণ রয়েছে তার আবির্ভাবের; তাই যুগে যুগে দেখা যাচ্ছে যে, অসংখ্য ইমাম মাহদীর মিথ্যা দাবিদারদের আবির্ভাব হয়েছে। হাদিসে এসেছে মাহদীর আগমনের পূর্বে অনেক ভণ্ড মাহদীর আবির্ভাব হবে। অন্যান্য যে সকল ইমামদের ব্যাপারে হাদিসে এসেছে তাদেরও অনেক মিথ্যা দাবিদার বের হয়েছে। যেমন খলীফা মানসূর এর সময় এবং পর পর তিন শাসক ক্ষমতাবলে তাদের নামের সাথে সিফাহ, মানসূর ও মাহদী যোগ করেছে। কিন্তু পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে যে, তারা সেই ব্যক্তিগণ নয়।

এখন তাই বলে আমরা যদি এ বিষয় এড়িয়ে যাই, এটা কোন সমাধান দিতে পারবে না। উল্টো এই সকল বিষয় না জানার ফলে আল্লাহর সত্য মনোনীত কোন খলীফা বা আমীরকে অস্বীকার করে বসবো, সেটাও মারাত্মক বিষয় হবে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ