৬.৭৩ তাওবার দরজা বন্ধ হবে

 কেয়ামতের আগে তাওবাহ এর দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। অর্থাৎ এরপর আর তওবা করলে তা কবুল হবে না। কিয়ামত মানুষের উপর তিন ভাবে হয়। (১) ব্যক্তি কিয়ামত, (২) প্রজন্মের মৃত্যু বা জাতি কিয়ামত, (৩) মহাপ্রলয় বা মহাকিয়ামত। হাদিসে বলা আছে-

হযরত আবু মুসা আশআরী (রা:) বলেন, রসূল বলেছেন, কিয়ামত তিন প্রকার- এক. ব্যক্তি কিয়ামত, দুই. জাতি কিয়ামত, তিন. পৃথিবী ধ্বংসের কিয়ামত, এটা একে অপরের থেকে ভয়ঙ্কর।
-       (আস-সুনানু কিতাবুল ফিরদাউস: ইবনে দায়লামী ১১৮০)

এই তিন সময় মানুষের তাওবাহ আর কবুল হয় না। ব্যক্তি কিয়ামত হচ্ছে মৃত্যু যখন গরগরা এর সময় চলে আসে। জাতি কিয়ামত হচ্ছে প্রজন্মের মৃত্যু বা জাতিগতভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত বা আল্লাহর আজাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত কিন্তু সকল কিছু ধ্বংস হয় না। আর মহাপ্রলয় বা মহা কিয়ামত, পুরো বিশ্বের ধ্বংস যা হবে নিকৃষ্টদের উপর। পশ্চিম দিকে সূর্য উঠার মাধ্যমেই তাওবাহ এর দরজা একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে, এরপরই কেয়ামত। এ থেকে বুঝা যায় যাদের উপর এই কিয়ামত হবে তারা কখনো আর তাওবাহ করার সুযোগ পাবে না। কুরআনে বলা আছে-

‘‘যেদিন আপনার পালনকর্তার কিছু নিদর্শন আগমন করবে তখন কোন আত্মার ঈমান আনয়ন তার কোন কাজে আসবে না- (সূরা আল আন্আম, ৬:১৫৮)

উপরে বর্ণিত তিন ধরণের কিয়ামাতই যা এক ব্যাক্তির উপর আসতে পারে, তবে সেগুলোর একটিও আসার আগে যদি ঈমান না এনে থাকে তাহলে তার ঈমান কার্যকরী হবে না। যেমন মৃত্যুর আগে যদি ঈমান না আনে, জাতিগত ধ্বংসের আগে যদি ঈমান না আনে আর কেয়ামতের আগে যদি ঈমান না আনে। আল্লাহ এর আগেই সুযোগ দেন কিন্তু তা অনেকেই গ্রহণ করে না। হাদিসে এসেছে-

হযরত আবু হুরায়রা (রা:) বলেন, রসূল বলেছেন, অবশ্যই আল্লাহ তা'আলা কিয়ামতের পূর্বে তাঁর বান্দাকে তওবা করার সুযোগ দেন। আর অহংকারীরা সেই সুযোগ গ্রহণ করে না।
-       (আস-সুনানু কিতাবুল ফিরদাউস ১১৮১)

উমাইয়্যাহ্ ইবনু বিস্তাম (রহঃ) ..... আবু হুরাইরাহ্ (রা:) এর সূত্রে নবী থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ছয়টি (আলামত সংঘটিত হওয়ার আগে) দ্রুত তোমরা নেক আমল করতে শুরু করো। তা হলো দাজ্জাল প্রকাশিত হওয়া, ব্যাপক ধোঁয়া দেখা দেয়া, দাব্বাতুল আরয (অদ্ভুত জন্ত) বের হওয়া, পশ্চিমাকাশ হতে সূর্যোদয় হওয়া, জাতিগত কিয়ামত এবং বাক্তিগত কেয়ামত বা মাওত।
-       (সহীহ, সহীহুল মুসলিম হাঃ একাঃ ৭২৮৮ [ইঃ ফাঃ ৭১৩১, ইঃ সেঃ ৭১৮৩])

আবু হুরায়রাহ (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ বলেছেন: তিনটি নিদর্শন যখন প্রকাশ পাবে তখন আর কারো ঈমান ও আমল তার কোন কাজে আসবে না, যদি তার পূর্বে ঈমান এনে না থাকে অথবা ঈমানের সাথে আমল সঞ্চয় না করে থাকে। আর তা হলো পশ্চিমাকাশ থেকে সূর্য উদিত হওয়া, দাজ্জালের আবির্ভাব এবং দাব্বাতুল আরদ বের হওয়া।
-       (সহীহ, মিশকাত হাঃ একাঃ ৫৪৬৭; সহীহুল মুসলিম ২৪৯-(২৫৮); সুনানে তিরমিযী ৩০৭২; মুসনাদে আহমাদ ৯৭৫; সহীহুল জামি' ৩০২৩)

পশ্চিম আকাশে সূর্য উঠলেই তাওবাহ এর দরজা বন্ধ হবে

মুআবিয়াহ (রা:) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ -কে বলতে শুনেছিঃ তাওবাহর দরজা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত হিজরাত শেষ হবে না। আর তাওবাহর দরজা বন্ধ হবে না যতক্ষণ পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত না হয়।
-       (সহীহ, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) | অধ্যায়ঃ ৯/ জিহাদ (كتاب الجهاد) | হাদিস নাম্বার: ২৪৭৯)

রসূলুল্লাহ বলেন: আল্লাহ তাআলা তাওবার জন্য পশ্চিমে একটি দরজা খুলে রেখেছেন যার প্রস্থ সত্তর বছরের সমান। সেদিক থেকে (অর্থাৎ পশ্চিম) সূর্য উদয় না হওয়া পর্যন্ত তা বন্ধ করা হবে না। এদিকেই আল্লাহ তাআলা ইঙ্গিত করে বলেন: যেদিন তোমার প্রতিপালকের কোন নিদর্শন আসবে সেদিন তার ঈমান কাজে আসবে না।
-       (সহীহ, সুনান আত তিরমিযী ৩৫৩৫; তাফসীর ইবনে কাসীর ৩/৩৬৯)

সাফওয়ান ইবনে আসসাল (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ বলেছেনঃ পশ্চিম দিকে একটি খোলা দরজা আছে, যার প্রস্থ সত্তর বছরের পথ। পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত না হওয়া পর্যন্ত এই দরজা সর্বক্ষণ তওবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এই দিক থেকে সূয উদিত হওয়ার পূর্বে কোন ব্যক্তি ঈমান না আনলে অথবা ঈমান আনার পর সৎকর্ম না করে থাকলে, অতঃপর তার ঈমান আনায় কোন উপকার হবে না।
-       (সুনান ইবনে মাজাহ | অধ্যায়ঃ ৩০/ কলহ-বিপর্যয় (كتاب الفتن) | হাদিস নাম্বারঃ ৩/৪০৭০)
-       (সুনান তিরমিযী ৩৫৩৫, ৩৫৩৬; আত-তালীকুর রাগীব ৪/৭৩। তাহকীক আলবানীঃ হাসান)

সাফওয়ান ইবনু আসসাল মুরাদি (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন যে, পশ্চিমে তাওবার জন্য একটি দরজা আছে। যার মাঝে প্রশস্ততা হল চলার সত্তর অথবা চল্লিশ বছর। তা কখনো বন্ধ হবে না। এমনকি তার দিক থেকে সূর্যোদয় হবে। অতঃপর তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করেন, যেদিন তোমার প্রভুর কতিপয় আলামত আসবে, সেদিন যারা পূর্বে ঈমান আনয়ন করেনি, তাদের ঈমান কোন উপকারে আসবে না। অথবা যে তার ঈমানের মধ্যে মঙ্গল কিছু অর্জন করেছে।
-       (সহীহ, আল ফিতান: নুয়াইম বিন হাম্মাদ, পথিক প্রকাঃ ১৮৫৪; মুসনাদে আহমাদ ১৭৬২৩)

আবূ মূসা আল আশ্আরী (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ বলেছেনঃ আল্লাহ তাআলা রাতে নিজের হাত বাড়িয়ে দেন, যাতে দিনের বেলায় গুনাহকারীর তাওবাহ্ করতে পারেন। আবার দিনের বেলায় তিনি তার হাত বাড়িয়ে দেন, যাতে রাতের বেলায় গুনাহকারীর তাওবাহ্ করতে পারেন। এভাবে তিনি হাত প্রসারিত করতে থাকবেন যতদিন না সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত হবে। (মুসলিম)
-       মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) | অধ্যায়ঃ পর্ব-১০. আল্লাহ তাআলার নামসমূহ (كتاب اسماء الله تعالٰى) | হাদিস নাম্বার: ২৩২৯-[৭]
-       (সহীহ, সহীহুল মুসলিম ২৭৫৯; সহীহাহ্ ৩৫১৩; সহীহ আত্ তারগীব ৩১৩৫; সহীহ আল জামি ১৮৭১)

ব্যাখ্যা: (إِنَّ اللّٰهَ يَبْسُطُ يَدَه) বলা হয়েছে, হাদীসাংশে হাত প্রশস্ত করা এর দ্বারা উদ্দেশ্য অনুসন্ধান করা। কেননা মানুষের স্বভাব হল তাদের কেউ যখন কারো কাছ থেকে কিছু সন্ধান করে তখন সে তার দিকে নিজ হাতের তালুকে বিস্তৃত করে, অর্থাৎ- আল্লাহ পাপীদেরকে তাওবার দিকে আহবান করছেন।

(لِيَتُوبَ مُسِىْءُ النَّهَارِ) অর্থাৎ- তাদের শাস্তির ব্যাপারে তিনি তাড়াতাড়ি করেন না বরং তাদেরকে তিনি ঢিল দেন যাতে তারা তাওবাহ্ করে।

(وَيَبْسُطُ يَدَه بِالنَّهَارِ لِيَتُوبَ مُسِىْءُ اللَّيْلِ) নাবাবী বলেন, এর অর্থ হল, তিনি পাপীদের থেকে দিনে রাত্রে তাওবাহ্ গ্রহণ করবেন যতক্ষণ পর্যন্ত পশ্চিম দিক থেকে সূর্য না উদিত হবে। আর তিনি তার তাওবাহ্ গ্রহণ কোন সময়ের সাথে নির্দিষ্ট করেননি। সুতরাং তাওবাহ্ গ্রহণের ক্ষেত্রে হাত বিস্তৃতকরণ রূপকার্থবোধক। মাযুরী বলেন, হাত বিস্তৃতকরণ দ্বারা তাওবাহ্ গ্রহণ উদ্দেশ্য। হাদীসে কেবল হাত বিস্তৃতকরণ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, কেননা আরবরা যখন কোন জিনিসের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে তখন সে তার হাতকে তা গ্রহণের জন্য বিস্তৃত করে এবং যখন কোন জিনিসকে অপছন্দ করে তখন তার হাতকে সে জিনিস থেকে গুটিয়ে নেয়। অতএব তাদেরকে ইন্দ্রিয়ানুভূত বিষয় দ্বারা সম্বোধন করা হয়েছে যা তারা বুঝে আর তা রূপকার্থবোধক, কেননা আল্লাহর ক্ষেত্রে দোষণীয় হাত সাব্যস্ত করা অসম্ভব, আল্লাহর হাত আল্লাহর মতো।

(حَتّٰى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا) অর্থাৎ- ‘‘তখন তাওবার দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘‘যেদিন আপনার পালনকর্তার কিছু নিদর্শন আগমন করবে তখন কোন আত্মার ঈমান আনয়ন তার কোন কাজে আসবে না- (সূরা আল আন্আম, ৬:১৫৮)।

ইবনুল মালিক বলেন, এ হাদীসের অর্থ এবং এর মতো অন্যান্য হাদীস ঐ ব্যাপারে প্রমাণ বহন করছে যে, পশ্চিম দিকে সূর্য উদিত হওয়ার পর থেকে নিয়ে কিয়ামাত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত তাওবাহ্ গ্রহণ করা হবে না।

রসূলুল্লাহ বলেন: যে ব্যক্তি সূর্য পশ্চিম আকাশে উদয়ের পূর্বে তাওবাহ করবে তার তাওবাহ কবূল করা হবে।
-       (মুসনাদে আহমাদ ৭৬৯৭)

তাই সময় ফুরিয়ে যাবার পূর্বে সময়ের মূল্যায়ন করা উচিত।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ