২.২ ওহী ও ইলহামের মধ্যে পার্থক্য

২.২.১ ওহী কি?

ওহী বা ওয়াহী (আরবি: وحي‎‎) শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, এমন সূক্ষ্ম ও গোপন ইশারা, যা ইশারাকারী ও ইশারা গ্রহণকারী ছাড়া তৃতীয় কেউ টের পায় না। এ সম্পর্কের ভিত্তিতে এ শব্দটি ইলকা বা মনের মধ্যে কোনো কথা নিক্ষেপ করা ও ইলহাম বা গোপনে শিক্ষা ও উপদেশ দান করার অর্থে ব্যবহৃত হয়। ব্যবহারিকভাবে ওহী দ্বারা ইসলামে আল্লাহ কর্তৃক নবী -রসূলদের প্রতি প্রেরিত বার্তা বোঝানো হয়। কুরআন মাজিদে বলা হয়েছে,

"নিশ্চয় আমি তোমার নিকট ওহী পাঠিয়েছি, যেমন ওহী পাঠিয়েছি নূহ ও তার পরবর্তী নবীগণের নিকট এবং আমি ওহী পাঠিয়েছি ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব, তার বংশধরগণ, ঈসা, আইয়ূব, ইউনুস, হারূন ও সুলায়মানের নিকট এবং দাঊদকে প্রদান করেছি যাবূর।" [কুরআন ৪:১৬৩]

ওহী মূলত আসতো নবী-রসূলদের কাছে। আর যত শরীয়াহ রয়েছে সেগুলো ওহীতে আসা বার্তাই। এটা ইলহামের চেয়ে বেশি ভারী ও বেশি মর্যাদার। এক কথায় নবী-রসূলদের কাছে পাঠানো বার্তাকে ওহী বলে, চাই তা যে মাধ্যমেই হোক। নবী-রসূলদের স্বপ্নও ওহী। কিন্তু সাধারণদের ক্ষেত্রে ইলহামী স্বপ্ন নবুয়াত বা ওহীর ৪৬ ভাগের ১ ভাগ বলা হয়।

২.২.২ ইলহাম, কাশফ ও স্বপ্ন কি?

প্রথমেই বলে নেই, ইলহাম, কাশফ, স্বপ্ন এগুলো শরীয়তের কোন দলিল না। অর্থাৎ এগুলো দিয়ে কেউ শরীয়তকে বদলাতে পারবে না। এগুলোর মাধ্যমে কেউ বিশেষ জ্ঞান পেলেও তা শরীয়ত দ্বারা যাচাই করতে হবে। তবে আল্লাহ অনেক অজানা জিনিস জানিয়ে দিতে পারেন এর মাধ্যমে যা তার জন্য উপকারী হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যেমন: মানুষ আল্লাহর কাছে কোন বিষয় ভালো না খারাপ তা জানার জন্য ইস্তেখারা করে। এর নামাজ পড়ে ও দুয়া করে। আর আল্লাহ তখন তাকে সেই বিষয়ে একটি ইঙ্গিত দেয় এবং সেই লোকটি সেই বিষয়টি সম্পর্কে অনুধাবন করতে পারে যে সেই বিষয়টি ভালো না খারাপ। ইলহাম, কাশফ, স্বপ্ন যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে হয় তাহলে তাতে যে বিষয়গুলো থাকে তা হচ্ছে বিশেষ জ্ঞান (অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যৎ বিষয়ে), আদেশ, নিষেধ, উপদেশ বা দিক নির্দেশনা।

ইলহাম কি?

ইলহামের শাব্দিক অর্থ হল চিন্তা ও চেষ্টা ছাড়াই কোন কথা অন্তরে উদ্রেক হওয়া। ইলহাম সহীহ হলে তাকে ইলমে লাদুন্নী বলা হয়ে থাকে। কিন্তু কথা হল ইলহামও স্বপ্নের ন্যায় কখনো আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়, আবার কখনো শয়তানের পক্ষ থেকে হয়। যে ইলহাম শরীয়তের হুকুম আহকাম সম্পর্কিত নয় এবং তার বিষয়বস্তু শরীয়তপন্থী নয় বা যে ইলহাম শরীয়তের কোন হুকুম আহকাম সম্পর্কিত কিন্তু এর পক্ষে শরীয়তের দলীলও বিদ্যমান থাকে, শুধু এ ধরণের ইলহামকেই সহীহ ইলহাম বলা হবে এবং ধরা হবে এটি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়েছে। এটি আল্লাহ তাআলার নিয়ামত বলে পরিগণিত হবে। এ ব্যাপারে তাঁর শোকর আদায় করা দরকার। আর যদি ইলহামে উপরোক্ত শর্তগুলো না পাওয়া যায়, তাহলে ধরে নেয়া হবে যে তা শয়তানের প্রলাপ ছাড়া আর কিছু নয়। এ ধরণের ইলহাম থেকে বিরত থাকা এবং তা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা আবশ্যক।

    -  (ফাতহুল বারী-১২/৪০৫; কিতাবুত তাবীর, বাব-১০; রূহুল মাআনী-১৬/১৬-২২; তাবসিরাতুল আদিল্লা-১/২২-২৩; মাওকিফুল ইসলাম মিনাল ইলহাম ওয়াল কাশফি ওয়াররুয়া-১১-১১৪)

এক কথায় যদি বলা হয়- ঐ সকল বাতেনী ফয়েজ [ইলহাম] যা যাহেরের [শরীয়তের] পরিপন্থী তা ভ্রান্ত।

        -        (তাফসীরে রূহুল মাআনী, ১৬/১৯)

হাদীসে এসেছে-

عَنْ عَبْدِ اللهِ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” إِنَّ لِلشَّيْطَانِ لِمَّةً، وَلِلْمَلَكِ لِمَّةً، فَأَمَّا لِمَّةُ الشَّيْطَانِ فَإِيعَادٌ بِالشَّرِّ، وَتَكْذِيبٌ بِالْحَقِّ، وَأَمَّا لِمَّةُ الْمَلَكِ فَإِيعَادٌ بِالْخَيْرِ، وَتَصْدِيقٌ بِالْحَقِّ، فَمَنْ وَجَدَ مِنْ ذَلِكَ فَلْيَعْلَمْ أَنَّهُ مِنَ اللهِ، فَلْيَحْمَدِ اللهَ، وَمَنْ وَجَدَ مِنَ الْآخَرِ فَلْيَتَعَوَّذْ مِنَ الشَّيْطَانِ، ثُمَّ قَرَأَ {الشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَيَأْمُرُكُمْ بِالْفَحْشَاءِ وَاللهُ يَعِدُكُمْ مَغْفِرَةً مِنْهُ وَفَضْلًا} البقرة: ٢٦٨

নিশ্চয় মানুষের অন্তরে শয়তানের পক্ষ থেকেও কথার উদ্রেক হয়, ফেরেশতার পক্ষ থেকেও কথার উদ্রেক হয়। ফেরেশতার উদ্রেক হল, কল্যাণের প্রতি প্রতিশ্রুতি দান এবং হকের সত্যায়ন করা। যে ব্যক্তি এটি অনুভব করবে, তাকে বুঝতে হবে যে, তা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে, তাই তার প্রশংসা করা উচিত। আর যে ব্যক্তি দ্বিতীয়টি অনুভব করবে, তাকে বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় কামনা করতে হবে। অতঃপর তিনি [বাকারার ২৬৮] আয়াত পাঠ করেন, অর্থাৎ শয়তান তোমাদের অভাব অনটনের ভীতি প্রদর্শন করে এবং অশ্লীলতার আদেশ দেয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে নিজের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও অধিক অনুগ্রহের ওয়াদা করেন।

        -        (সুনানুল কুবরা লিননাসায়ী ১০৯৮৫; সহীহ ইবনে হিব্বান ৯৯৭; মুসনাদে আবী ইয়ালা ৪৯৯৯; সুনানে তিরমিজী ২৯৮৮)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) বলেন, রসূল বলেছেন, আমার উম্মতের আল্লাহর পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ উপহার হলো তারা ইলহাম পাবে। যেমন আমার জামানাই উমর (রা:) পেয়েছে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল ইলহাম কি? তিনি বললেন, গোপন ওহী। যার মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলবেন।

        -        (আস-সুনানু কিতাবুল ফিরদাউস ৭৯৬)

তবে যদি তা ইসলামী শরীয়তের সাথে বিপরীত না হয়, তাহলে তাকে কি করতে বলা হয়েছে তা আপনারা উপরের ব্যাখ্যা দিয়ে বুঝেছেন। হাদিসে এসেছে তার প্রশংসা করা উচিত। হাদিসে এসেছে ১২ জন খলীফা বা ইমাম আসবে এবং আরেক হাদিসে বলা হয়েছে তারা সকলেই ইলহামপ্রাপ্ত হবেন। যেমন ইমাম মাহমুদ, ইমাম মাহদী, ইমাম মানসূর, ইমাম জাহজাহ আর সর্বশেষ আসবেন ঈসা (আঃ) যিনি আমাদের শেষ নবীর কুরআনের শরীয়তই মানবেন। তিনিও আল্লাহ হতে বিশেষ জ্ঞান ও বার্তা পাবেন।

ইলহাম মূলত এক ধরনের বার্তা যা আল্লাহর পক্ষ থেকে হয় কিন্তু তা ওহী নয়। নবী-রসূলদের যে বার্তা পাঠানো হয় তা ওহী হিসেবে গণ্য এছাড়া আউলিয়া কেরাম, আল্লাহর মনোনীত খলীফা, মুজাদ্দিদ, ইমাম বা আমীরগণ যে সকল বার্তা পান তা ইলহাম হিসেবে গণ্য হয়। এই ইলহাম ওহীর সকল মাধ্যমেই হতে পারে। দুটির বার্তা বাহকই রুহুল আমিন, রুহুল কুদ্দুস হজরত জিবরাইল (আঃ) হতে পারেন, তবে এটি সেই ব্যক্তির মর্যাদা অনুসারে হয়ে থাকে। কিন্তু যারা আল্লাহর খলীফা, ইমাম বা মুজাদ্দিদ হবেন তারা সাধারণ আউলিয়া কেরাম থেকে বেশি মর্যাদা রাখেন। এমন কি ইমাম মাহদীর আত্মপ্রকাশের সময় জিবরীল (আঃ) নিজেই ইমাম মাহদীর সত্যায়ন করবেন মানুষদেরকে প্রকাশ্যে যা হাদিসে উল্লেখিত হয়েছে।

সিরাত থেকে একটি ঘটনা উল্লেখ করা হলো যাতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়- নবী করীম প্রচার-মাধ্যমের গুরুত্বকে কখনো অবহেলা করেননি, বরং মিডিয়াযুদ্ধের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে সে যুগের প্রচলিত প্রচার মাধ্যমকে সময় ও সুযোগ মতো পূর্ণাঙ্গরূপে ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ইসলামপূর্ব যুগে কাবার দেয়ালকে সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করা হতো। কাফেররা বিভিন্ন কুৎসামূলক কথা রটনা করত। তখন নবী রসূলের কবি খ্যাত হযরত হাসসান বিন সাবেত (রা:) কে বলতেন, হে হাসসান! আল্লাহর রসূলের পক্ষ থেকে জবাব দাও। আল্লাহ রূহুল কুদস (জিবরাইল) দ্বারা তোমাকে সাহায্য করবেন। নির্দেশ পালনার্থে হযরত হাসসান বিন সাবেত (রা:) নিজের ইলহামী কাসীদার সাহায্যে কাফের-মুশরিক ও ইসলামের শত্রুদের এমন দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতেন যে, তাদের কয়েক পুরুষ পর্যন্ত তারা একথা ভুলতে পারত না। এখানে আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান দিয়ে সে কবিতা লিখতো। হাদিসে এসেছে-

আলী ইবনু আবদুল্লাহ (রহঃ) ... সাঈদ ইবনু মূসাইয়্যাব (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা উমর (রা:) মসজিদে নববীতে আগমন করেন, তখন হাসসান ইবনু সাবিত (রা:) কবিতা আবৃত্তি করছিলেন। (উমর (রা:) তাঁকে বাঁধা দিলেন) তখন তিনি বললেন, এখানে আপনার চেয়ে উত্তম ব্যাক্তি (রসূল ) এর উপস্থিতিতেও আমি কবিতা আবৃত্তি করতাম। তারপর তিনি আবূ হুরায়রা রাঃ-এর দিকে তাকালেন এবং বললেন, আমি আপনাকে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করছি; আপনি কি রসূলুল্লাহ কে বলতে শুনেন নি যে, তুমি আমার পক্ষ থেকে জবাব দাও। হে আল্লাহ! আপনি তাকে রুহুল কুদ্দুস (জিবরীল আঃ) দ্বারা সাহায্য করুন। তিনি উত্তরে বললেন, হ্যাঁ।

        -        (সহীহ, সহীহ বুখারী ইসঃ ফাঃ ২৯৮৫)

হাফস ইবনু উমর (রহঃ) ... বারা (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী হাসসান (রা:) কে বলেছেন, তুমি তাদের (কাফিরদের) কুৎসা বর্ণনা কর অথবা তাদের কুৎসার উত্তর দাও। তোমার সাথে (সাহায্যার্থে) জিবরীল (আঃ) আছেন।

        -        (সহীহ, সহীহ বুখারী ইসঃ ফাঃ ২৯৮৬)

আয়িশা (রা:) বলেন, এরপর আমি রসূলুল্লাহ কে হাসসান সম্পর্কে বলতে শুনেছি যে, যতক্ষন পর্যন্ত আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে কাফিরদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে থাকবে ততক্ষন পর্যন্ত রুহুল কুদ্দুস অর্থাৎ জিবরীল (আঃ) সারাক্ষণ তোমাকে সাহায্য করতে থাকবেন। আর তিনি [আয়িশা রাঃ] বলেন, আমি রসূলুল্লাহ কে বলতে শুনেছি যে, হাসসান তাদের (বিরুদ্ধে) নিন্দাবাদ করলেন। তিনি মুমিনদের অন্তরে প্রশান্তি এনে দিলেন এবং আত্মতৃপ্তি লাভ করলেন। (প্রয়োজনীয় অংশ)

        -        (সহীহ, সহীহ মুসলিম ইসঃ ফাঃ ৬১৭০)

সর্বপ্রথম যেটি জানা দরকার, এখন আর কেউ ওহী পাবে না। আর যে বলবে সে ওহী পাচ্ছে, সে নিশ্চয়ই মিথ্যাই বলছে। এমন কি ইমাম মাহদী যে গুপ্ত ইলম পাবে সেটিও ইলহাম হবে। সেটি ওহী এর চেয়ে হালকা হয়ে থাকে ভারে। আর এ দিয়ে কখনই শরিয়াহ পরিবর্তন করা যাবে না। যদি ইলহাম থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান শরিয়াহ এর বিপরীত হয় তাহলে তা ছুড়ে ফেলে দিতে হবে। হাদিসে এসেছে,

হযরত বাকের (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, হযরত কাজিম (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, যামানার ইমামগণ ইলহাম প্রাপ্ত হন, আর ইমাম মাহদীও আল্লাহর গোপন বাণী (ইলহাম) পাবেন।

        -        (আস-সুনানু কিতাবুল ফিরদাউস ১০৮৬)

আর যারা মুজাদ্দিদ, আল্লাহর মনোনীত বান্দা হবেন, ইমাম হবেন, তারা আল্লাহ থেকে সরাসরি সব সময় ইলহাম প্রাপ্ত হবেন এবং অনেক অজানা বিষয় তাদেরকে জানিয়ে দিবেন। এর মাধ্যমে সেই ব্যক্তিকে সঠিক বিষয়ের জ্ঞান দিয়ে হেদায়েতের পথে রাখেন। ইলহাম বা কাশফ বা স্বপ্নের মাধ্যমে অনেক রহস্য আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দিতে পারেন যদি সে আসলেই আল্লাহ এর প্রিয় বান্দা বা মনোনীত বান্দা হয়। আর গুপ্ত জ্ঞান আল্লাহর কাছেই। তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করে থাকেন। এতে কারো হাত নেই। আমাদের পূর্বে গত হওয়া মনিষীদের জীবনী ভিত্তিক লেখা তারিখে দাওয়াত ওয়া আজিমাত বাংলা সংস্করণ সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস বইটিতে অনেক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যার ব্যাপারে বেশির ভাগ উলামায়ে কেরামই একমত।

কাশ্‌ফ কি?

কাশ্‌ফ মানে হল অজানা কোন বিষয় নিজের কাছে প্রকাশিত হওয়া। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকেও হয় আবার শয়তানের পক্ষ থেকেও হয়। এই কাশফ কখনো সঠিক হয় আবার কখনো মিথ্যা হয়, যেমন স্বপ্নে হয়ে থাকে। কখনো বাস্তবসম্মত হয়, কখনো বাস্তব পরিপন্থী হয়। তাই এটি শরীয়তের দলীলতো নয়ই, উপরন্তু এটিকে শরীয়তের কষ্টিপাথরে যাচাই করা আবশ্যক।

এমনিভাবে কাশফ ইচ্ছাধীন কোন বিষয় নয় যে, তা অর্জন করা শরীয়তে কাম্য হবে বা সওয়াবের কাজ হবে। অনুরূপ কাশফ হওয়ার জন্য বুযুর্গ হওয়াও শর্ত নয়। বুযুর্গ তো দূরের কথা, মুমিন হওয়াও শর্ত নয়। কাশফ তো ইবনুস সাইয়্যাদের মত দাজ্জালেরও হতো। সুতরাং কাশফ বুযুর্গ হওয়ার দলীল হতে পারে না।

    - (মাওকিফুল ইসলাম মিনাল ইলহাম ওয়াল কাশফি ওয়াররুয়া-১১-১১৪; রূহুল মাআনী-১৬/১৭-১৯; শরীয়ত ও তরীকত কা তালাযুম-১৯১-১৯২; শরীয়ত ও তরীকত-৪১৬-৪১৮; আত তাকাশশুফ আন মুহিম্মাতিত তাসাওউফ-৩৭৫-৪১৯)

হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী (রহ:) বলেন, বুযুর্গদের যে কাশফ হয়ে থাকে, তা তাঁদের ক্ষমতাধীন নয়। হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর ব্যাপারটি লক্ষ্য করুন। কত দীর্ঘদিন পর্যন্ত ছেলে ইউসুফ (আঃ) এর কোন খবর তাঁর ছিল না। অথচ খবর না পাওয়ার কারণে যে কষ্ট তিনি পেয়েছেন তা সবারই জানা। কাঁদতে কাঁদতে তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। যদি কাশফ ইচ্ছেধীন কোন কিছু হতো, তাহলে ইয়াকুব (আঃ) কেন কাশফের মাধ্যমে খবর পেলেন না? আর যখন বিষয়টি জানার সময় হল, তখন বহু মাইল দূর হতে হযরত ইউসুফ (আঃ) এর জামার ঘ্রাণ পর্যন্ত পেতে লাগলেন। সুতরাং, কাশফ যখন কারো ইচ্ছেধীন নয়, তখন এটাও অপরিহার্য নয় যে, বুযুর্গদের সর্বদা কাশফ হতেই থাকবে।

        -        (ইলম ও আমল, বাসায়েরে হাকীমুল উম্মত ২১৫-২১৬)

কাশ্ফ হতে অর্জিত জ্ঞান কতটুকু আমলযোগ্য?

কাশফ মূলত আরবী শব্দ। যার অর্থ উম্মুক্ত হওয়া, বাতেনী রহস্যাদি সম্পর্কে অবগত হওয়া। তরিকতের দৃষ্টিতে কাশ্ফ হচ্ছে এক ধরনের অন্তর্দৃষ্টি, যার সাহায্যে প্রকৃত অলি ও সাধক বাতেনী জগতের দৃশ্য, অদৃশ্য বিষয়াদি এবং আল্লাহ্ তাআলার জাত ও সিফাতকে জানতে প্রয়াস পান। এবং ভবিষ্যত জগতের অনেক কিছু তাদের নিকট স্পষ্ট হয়ে যায়। তবে এটা অর্থাৎ কাশ্ফ প্রকৃত আল্লাহ্‌র বন্ধুদের জন্য আল্লাহ্‌র পক্ষ হতে খাস দয়া ও করুণা। কোন কোন তরিকতপন্থী সূফির নিকট কাশ্ফ লব্ধ জ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান। কিন্তু হযরত শাহ্ ইমাম আহমদ রেযা খাঁন রহমাতুল্লাহি আলাইহি সহ অনেক বুজর্গানে দ্বীন, প্রসিদ্ধ ও হকপন্থী ইমামদের উক্তি উদ্ধৃতি পূর্বক লিখেছেন যে, আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাতে রসূল তথা শরিয়তের বিধি-বিধানকে ওলিদের কাশ্ফ অতিক্রম করতে পারে না। কুরআন ও প্রিয়নবীর সুন্নাহ্ তথা ওহীর মাধ্যমে যে ইলম অর্জিত অর্থাৎ ইলমে দ্বীন এটাই মূলজ্ঞান। প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সাধক- হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমাদের সূফীদের ইলম (হাল ও কাশ্ফ) হল মহান আল্লাহ্ তাআলার কিতাব ও রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত দ্বারা আবদ্ধ। আর যে কাশ্ফের স্বপক্ষে কিতাবুল্লাহ্ ও সুন্নাতে রসূল সাক্ষ্য দেয় না তা কোন বস্তুই নয় (অর্থাৎ তা ভ্রান্ত)। আর তাই প্রকৃত অলিদের ইলম তথা কাশ্ফ অর্জিত জ্ঞান কখনো কিতাবুল্লাহ্ তথা আল্লাহ্ তাআলার কিতাব ও সুন্নাতে রসূলের বাইরে যাবে না। যদি সামান্য পরিমাণও বাইরে যায় তাহলে বুঝতে হবে যে তা প্রকৃত ইলম নয়, প্রকৃত সূফীদের কাশ্ফও নয়। বরং নিছক মূর্খতা।

আল্লাহ্ তাআলা শয়তানকে এমন ক্ষমতা দিয়েছেন, সে বহু কাশ্ফের অধিকারী ব্যক্তিকে ধোকায় পতিত করে। ফলে ঐ ধরনের কাশ্ফের দাবীদার ভন্ডরা সেটাকে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে মনে করে। এটার উপর আমল করে নিজে যেমন পথভ্রষ্ট হয় অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করে। ঐ জন্যই শরিয়ত তরিকতের প্রখ্যাত ও প্রকৃত শায়খ ও ইমামগণ কাশ্ফ দ্বারা অর্জিত ইলমের/জ্ঞানের উপর আমল করার পূর্বে তা কিতাবুল্লাহ্ তথা আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাতে রসূলের মাপকাঠিতে যাচাই করে নেন। যদি কাশ্ফে অর্জিত জ্ঞান কিতাবুল্লাহ্ ও সুন্নাতের অনুরূপ হয় তবেই তা আমলযোগ্য, নতুবা তা পরিত্যাজ্য এবং আমল যোগ্য নয়। বরং তা শয়তানের প্রতারণা মনে করতে হবে।

        -        (ফতোয়ায়ে রজভীয়া)

স্বপ্ন কি?
হাদিসে সরাসরি এসেছে, স্বপ্ন নবুয়তের ৪৬ ভাগের ১ ভাগ। এটিও কাশফ বা ইলহামের মত আল্লাহ প্রদত্ত হতে পারে আবার শয়তান থেকেও হতে পারে। স্বপ্নে অনেক কিছু মানুষ দেখতে পারে। এবং স্বপ্নেও রুহুল কুদ্দুসও আসতে পারেন বার্তা নিয়ে। তবে তা বিশেষ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। ভালো স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ হতে হয়ে থাকে আর খারাপ স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ হতে হয়ে থাকে। আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্য স্বপ্নকে ইলহামী স্বপ্নও বলা হয়। আরো দেখুন- (স্বপ্ন অধ্যায়, গ্রন্থঃ রুহ -ইবনুল কাইয়িম (রহ:))

এ বইটিতে স্বপ্নের ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা, বিভিন্ন প্রকার এবং সহীহ দলিল ও বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে অনেক বিষয় তুলে ধরেছেন। বইয়ের আকার ছোট রাখার জন্য আরো বিস্তারিত আলোচনা এখানে তুলে ধরলাম না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ