১.১ কেন মনে করি না আমরা শেষ জামানায়

শেষ জামানা বলতে বুঝায়, যে জামানার শেষ কালেই চূড়ান্ত মহাপ্রলয় বা কিয়ামত সংঘটিত হবে। আরো অনেক বিষয় আছে যা কারণ হিসেবে বলা যায়, যাতে মানুষকে গাফেল বানানো হয়েছে এই শেষ জামানা সম্পর্কে। রসূল ও তার সাহাবীগণ আমাদের বর্তমান জামানার বিষয়ে আগে থেকেই জানিয়ে গিয়েছেন এবং সেই সকল আলামতও যা শেষ জামানায় ঘটবে। হাদিসে এসেছে-

ইয়াকুব ইবনু ইবরাহীম আদ দাওরাকী ও হাজ্জাজ ইবনু আশ শাইর (রহঃ) ..... আবূ যায়দ (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রসূলুল্লাহ আমাদেরকে নিয়ে ফজরের সালাত আদায় করলেন। তারপর মিম্বারে আরোহণ করে ভাষণ দিলেন। পরিশেষে যুহরের সালাতের সময় উপস্থিত হলে তিনি মিম্বার হতে নেমে সালাত আদায় করলেন। তারপর পুনরায় মিম্বারে উঠে তিনি ভাষণ দিলেন। এবার আসরের সালাতের ওয়াক্ত হলে তিনি মিম্বার থেকে নেমে সালাত আদায় করে পুনরায় মিম্বারে উঠলেন এবং আমাদেরকে লক্ষ্য করে খুতবাহ্ দিলেন, এমনকি সূর্যাস্ত হয়ে গেল, এ ভাষণে তিনি আমাদেরকে পূর্বে যা ঘটেছে এবং ভবিষ্যতে যা ঘটবে ইত্যকার সম্বন্ধে সংবাদ দিলেন। তিনি (বর্ণনাকারী) বলেন, যে লোক এ কথাগুলো সর্বাধিক মনে রেখেছেন আমাদের মধ্যে এ সম্বন্ধে তিনিই সবচেয়ে বেশী জানেন।
-        (সহীহ, সহীহুল মুসলিম হাঃ একাঃ ৭১৫৯-(২৫/২৮৯২) [ইঃ ফাঃ ৭০০৩, ইঃ সেঃ ৭০৬০])

আমরা সেই সকল হাদিস পড়লে বুঝতে পারি যে আমরাই শেষ জামানার অধিবাসী। আমাদের থেকে কেয়ামতের দূরত্ব খুবই কম। দুনিয়ার চাকচিক্য ও বিধর্মীদের প্রভাব আজ এতই প্রকট যে সাধারণ মুসলিমরা এমনকি আলিমগণও এখন এই বিষয়ে গাফেল। আমরা যে শেষ জামানায় আছি তা অনেকেই মানতে চায় না। তারা দুনিয়ার মোহে এবং দীর্ঘ বছর জীবিত থাকার স্বপ্নে বিভোর। তাদের এত সুন্দর করে গুছানো দুনিয়া যে নষ্ট হয়ে যাবে তা তারা শুনতেও চায় না। এছাড়াও রয়েছে অন্ধকার ফিতনা। আমরা বুঝতে পারছি না যে কোনটি ইসলামের সঠিক পথ ও পন্থা। কারণ বর্তমানে দেখা যায় বিভিন্ন ফিরকা, শত বিভক্তি, সত্য গোপন, দরবারী আলেম কর্তৃক কুরআন-হাদিসের অপব্যাখ্যা, বিশেষ করে ফরজ বিধান জিহাদের অপব্যাখ্যা ও জালিম শাসকের পক্ষে ইসলাম বিরোধী ফতোয়া। আমরা ইসলাম ছেড়ে যে অন্য জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করে আছি আর মনে করছি যে সঠিক ইসলামই পালন করছি, এটাও এই জামানার এক ভয়াবহ ফিতনা। তবে আমরা যদি শেষ জামানা সম্পর্কে জ্ঞান রাখতে পারি তাহলে এরকম সকল ফিতনা থেকে বাঁচতে পারবো, ইনশাআল্লাহ। হ্যাঁ, তবে সে বিষয়ে সঠিক জ্ঞান থাকলেই তা কেবল সম্ভব।

এই যুগে শেষ জামানার আলামত বিষয়ে, ঘটিতব্য ফিতনা সম্পর্কে, শেষ জামানায় প্রকাশ পাওয়া হক নেতা ও পথভ্রষ্টকারী নেতাদের বিষয়ে কথা বলা জিহাদের কথা বলার মতই ভয়ের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে যার ব্যাপারে হাদিসেই এসেছে। যা বর্ণনা করার কারণে মৃত্যুও হতে পারে এবং বিভিন্ন সাহাবী (রা:) ও তাবেঈন ও হকপন্থী অনেক আলেমরাও এ নিয়ে মুখ খুব কমই খুলেছে। যদি শেষ জামানার হাদিসগুলি দেখি। এই সকল হাদিসের সনদ, বর্ণনাকারী খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর। এমনকি এই সকল হাদিস পাওয়াও দুষ্কর কারণ এগুলি সবচেয়ে কম সংরক্ষিত হয়েছে। ফিতনার জামানায় ফিতনা সম্পর্কে না জানার কারণেও আমরা শেষ জামানা চিনতে পারছি না। অথচ আমাদের থেকে কেয়ামত এতই নিকটে যে, তা যেন একটি প্রাণী বাচ্চা প্রসব করার সময়টুকু।

আমরা আজ প্রভাবিত হয়ে অন্য কোন নীতি, তথ্য-সূত্র বা হলুদ মিডিয়া দিয়ে এই জামানা চিনে থাকি। কারণ তারা আমাদের এই সম্পর্কে তথ্য দিতে থাকে। আজকের দুনিয়ার রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, পরিবার-ব্যবস্থা এমনভাবে চলমান ও পরিকল্পিত হচ্ছে যে, যাতে মনে হবে এই দুনিয়ার কোন শেষ সময় আসবেই না বা নেই। হাজার বছরেও দুনিয়া ধ্বংসের কোন আলামত পাওয়া যাবে না। এমনকি দুনিয়া ধ্বংসের সময় সম্পর্কে কোন চিন্তাও নেই। এটাকে নিছক আগের সেই কুসংস্কার বলেও উড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু যারা ইসলাম সম্পর্কে সর্বনিম্ন জ্ঞান রাখে তারা জানে যে, এই ধর্মের মূলই হচ্ছে আখিরাত। আর এই পৃথিবীর একদিন ধ্বংস হবেই যাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে কবে হবে এটাই মূলত জানার বিষয়। এটার সঠিক সময় না জানলেও এর আগের ঘটিতব্য ফিতনা, মালহামাগুলোকে হাদিস থেকে চিহ্নিত করা সম্ভব যা আমাদের জামানা চিনতে সাহায্য করবে। আর সেই কুরআন-হাদিস অনুযায়ী মিলিয়ে দেখলে বুঝা যায় যে আমরা কেয়ামতের খুবই নিকটবর্তী রয়েছি। কারণ ১৪০০ বছর আগেই কেয়ামতের দূরত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে যে-

আনাস (রা:) থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ বলেছেনঃ আমার প্রেরণ আর কিয়ামত হল এই। বর্ণনাকারী আবূ দাউদ তর্জনী এবং মধ্যমার দিকে ইঙ্গিত করে দেখালেন দুই আঙ্গুলের মত। আর এ দুটোর মাঝে তেমন কোন ব্যবধান নেই।
-        (সহীহ, সুনান আত তিরমিজী (আল মাদানী প্রকাঃ) ২২১৪ [ইঃ ফাঃ ২২১৭]; বুখারি; মুসলিম)

কিছু হাদিসের বিশ্লেষণে পাওয়া যায় যে, উম্মতের হায়াত (হিজরি থেকে শুরু) একদিন ও আরো অর্ধ দিনেরও কিছু বেশি অর্থাৎ ১৫০০ বছর ও তার কিছু বেশি সময় যার মধ্যে ১৪৪০ চলে গেছে। কিন্তু চিন্তার বিষয় এই যে, মানুষ দুনিয়াবী সুখে আসক্ত হয়ে আখিরাত ভুলে গেছে। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছি বিভিন্ন দুনিয়াবী ফিতনা আর সাথে পাপাচারের ছয়লাব। আমাদের সব ব্যবস্থাগুলো পরিকল্পিত হচ্ছে হাজার বছরের জন্য। আমাদের প্রত্যেকটি জায়গায় আজ প্রতিযোগিতা চলছে এই নিয়ে। তবে এটাই যে শেষ জামানা তা বুঝতে হলে আমাদের আবারো ইসলামী জ্ঞান চর্চা করতে হবে। এই শেষ জামানা সম্পর্কে হাদিসে আসা আলামতগুলী বাস্তবায়িত হয়েছে, হচ্ছে এবং বাকিগুলোও দ্রুতই ঘটতে যাচ্ছে। আমাদের জামানার পরিস্থিতি তা বলে দিতে পারে। তারপরও আমরা মনে করি না যে আমরা শেষ জামানায় এর মূল একটি কারণ হচ্ছে এই দুনিয়ার ধোঁকা। দুনিয়া হচ্ছে ধোঁকার সামগ্রী। তাই কেয়ামত কত কাছে এটি বুঝতে আমাদের শেষ জামানার হাদিসগুলো অধ্যায়ন ও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। আর এর জন্য আমাদের সাহসী পদক্ষেপও নেওয়া দরকার।

ফিতনার হাদিস বর্ণনা করতে সাহসী হওয়া, ভয় করা

মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু নুমায়র ও মুহাম্মাদ ইবনুল আলা আবু কুরায়ব (রহঃ) ...... হুযাইফাহ (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা উমর (রা:) এর নিকট উপবিষ্ট ছিলাম। এ সময় তিনি বললেন, ফিতনাহ্ বিষয়ক রসূলুল্লাহ এর বাণী তোমাদের কার মনে আছে? আমি বললাম, আমার মনে আছে। এ কথা শুনে তিনি বললেন, ব্যস! তুমি তো খুব সাহসী। তিনি কি বলেছেন, বলো! তারপর আমি বললাম, আমি রসূলুল্লাহ কে বলতে শুনেছি যে, পরিবার-পরিজন, ধন-সম্পদ, স্বীয় নাফস, সন্তান-সন্ততি এবং প্রতিবেশীর ব্যাপারে মানুষ যে ফিতনায় জড়িত হয়, তার সিয়াম, সালাত, সাদাকা এবং সৎকার্যের আদেশ ও অসৎকার্যে বাধা দানই হলো এগুলোর জন্য কাফফারাহ। এ কথা শুনে উমর (রহঃ) বললেন, আমি তো এ ফিতনার ব্যাপারে শুনতে চাইনি বরং সমুদ্রের তরঙ্গমালার মতো যে ফিতনাহ নিপতিত হতে থাকবে, আমি তো শুধু তাই শুনতে চেয়েছি। তখন আমি বললাম, হে আমীরুল মুমিনীন! এ ফিতনার সাথে আপনার কি সম্পর্ক, এতে আপনার উদ্দেশ্য কি? এ ফিতনাহ্ ও আপনার মধ্যে এক রুদ্ধদ্বার অন্তরায় রয়েছে। তিনি প্রশ্ন করলেন, এ দ্বার কি ভাঙ্গা হবে, না খোলা হবে? আমি বললাম, না, খোলা হবে না, বরং ভাঙ্গা হবে। এ কথা শুনে উমার (রা:) বললেন, তবে তো তা আর কক্ষনো বন্ধ হবে না। বর্ণনাকারী শাকীক (রহঃ) বলেন, আমরা হুযাইফাহ (রা:) কে প্রশ্ন করলাম, কে সে দ্বার, উমার (রা:) তা কি জানতেন? উত্তরে তিনি বললেন, হ্যাঁ, আগামী দিনের পর রাত্র, এ কথাটি যেমন জানতেন, ঠিক তদ্রুপ ঐ বিষয়টিও তিনি জানতেন। হুযাইফাহ (রা:) বলেন, আমি তাকে ভুল হাদীস শুনাইনি। শাকীক (রহঃ) বলেন, কে সে দরজা, এ বিষয়ে হুযাইফাহ্ (রা:) কে প্রশ্ন করতে আমরা ভয় পাচ্ছিলাম। তাই আমরা মাসরুক (রহঃ) কে বললাম, আপনি তাকে প্রশ্ন করুন। তিনি হুযাইফাহ (রা:) কে প্রশ্ন করলেন। হুযাইফাহ (রা:) বললেন, এ দরজা হচ্ছে স্বয়ং উমার (রা:)।
-        (সহীহ, সহীহুল মুসলিম হাঃ একাঃ ৭১৬০-(২৬/১৪৪) [ইঃ ফাঃ ৭০০৪, ইঃ সেঃ ৭০৬১]; সুনান ইবনে মাজাহ ৩৯৫৫; আল ফিতান: নুয়াইম বিন হাম্মাদ ৬০, ৬৫, ৬৭)

হযরত সামুরা ইবনে জুনদুব (রা:) বলেন, কিয়ামত সংঘঠিত হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা বড় বড় কিছু বিষয় স্বচক্ষ্যে দেখবেনা এবং তোমরা সেগুলো নিজেদের মধ্যেও আলোচনা করার সাহস পাবে না।

-        (যঈফ, আল ফিতান: নুয়াইম বিন হাম্মাদ ৪০; আল-বাদউ ২৪৪)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ